★( শোকাবহ ১০ই মহরম এর – কারবালার ঘটনাঃ——
★★ ইয়াজিদের ইসলামী শাসন ব্যবস্থার ঘটোনা ইমাম হুসাইনের মত মুমীন ব্যক্তির পক্ষে সেটা মেনে নেয়া কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না। খিলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনই ছিল ইমাম হোসাইনের (রাঃ) সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থনও ছিল তার পক্ষে। উপরন্তু কুফাবাসীগন ইয়াজিদের অপশাসনের হাত থেকে বাচার জন্যে বারংবার ইমাম হুসাইন এর সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকলে তিনি তাতে সাড়া দেন। তিনি কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কুফার অবস্থা জানার জন্যে হুসাইন তার চাচাতো ভাই মুসলিম-বিন-আকিলকে সেখানে প্রেরণ করেন। মুসলিম কুফাবাসীর সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে ইমাম হুসাইনকে কুফায় আসতে অনুরোধ করে পত্র লিখেন।
কিন্তু এরিমধ্যে ইয়াজিদের অধিনস্থ ইরাকের শাসনকর্তা কঠিন হৃদয়ের ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ মুসলিমকে খুজে বের করে তাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে এবং তাকে সহায়তাকারীদেরও খুজে হত্যা করে। এতে কুফাবাসীরা ভীত হয়ে পড়ে। তারা হুসাইনের সাহায্যে এগিয়ে আসতে আর সাহস পেলো না। কুফাবাসীরা ইমাম হুসাইনকে খলিফা হিসাবে দেখতে চাইলেও ইমাম হুসাইনের জন্য প্রাণ বিসর্জণ দিতে রাজি ছিল না। ইয়াজিদের নির্মমতার কথা জেনেও ইমাম হোসাইন (রাঃ) এর সঙ্গীরা যে জেনে শুনে বুঝেই ইমামের সাথে যোগ দিয়ে ছিলেন তা খুবই স্পষ্ট। ইমামকে ভালো বেসে, তার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রেখেই তারা ইমামের সাথে থেকে প্রাণপণে সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছেন।
ইমাম হোসাইন (রাঃ) এবং তার সঙ্গীদের ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে, তরবারীর সেই আঘাতের যন্ত্রণার চেয়ে আরো বেশি কষ্টকর ছিল জনগণের অজ্ঞতা এবং মূর্খতার আঘাত। সে জন্যেই জনতার চিন্তার ভূবন থেকে অজ্ঞতার পর্দা অপসারণ করাটাই ছিল তাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ।
মুসলিম প্রেরিত পত্র পেয়ে ইমাম হুসাইন স্ত্রী, পুত্র কন্যা, আত্মীয়-স্বজন এবং ২০০ অনুচর সহ কুফার পথে রওনা হন। কুফার ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর হুসাইনকে ইয়াজিদের আনুগত্যের শপথ গ্রহনের নির্দেশ দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তারা ফোরাত নদীর তীর ঘিরে দর্ন্ডায়মান হলো এবং হুসাইন শিবিরের পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিলো।
তাসূয়ার দিনে কারবালার পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ইমামের সঙ্গীরা অবিচল আস্থা ও ইমানের সাথে নিজেদের দায়িত্ব পালন কর ছিলেন। চরম সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও তারা ইমামের সাথে কৃত তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করেননি। এই অনড় ইমানের অধিকারী একজন ছিলেন হযরত আব্বাস (রাঃ)। তিনি ছিলেন হযরত আলি (রাঃ) এর ছেলে।তার মা ছিলেন উম্মুল বানিন। হযরত আব্বাস ছিলেন অকুতোভয় এক যুবক। তার ইমান, বীরত্ব, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলির কথা ছিল প্রবাদতুল্য। দেখতেও তিনি ছিলেন খুব সুন্দর। কারবালার অসম যুদ্ধে তিনিই ছিলেন ইমাম পক্ষের প্রধান সিপাহসালা। ইমামের প্রতিরক্ষায়, নারী ও শিশুদের তাবুর প্রতি রক্ষায় এবং ইমাম হোসাইন (রাঃ) এর সন্তানদের জন্যে পানির ব্যবস্থা করতে প্রাণপণে লড়েছেন তিনি।
অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবেন যিয়াদের ৪ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইন(রাঃ) কে অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। মাত্র ২০০ মানুষের বিপক্ষে ৪০০০ সৈন্য। পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়ায় ইমামের কচি সন্তানেরা প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে হযরত আব্বাস (রাঃ) ফোরাতে যান পানি আনতে। নিজেও তিনি ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলেন। আজলা ভরে পানি তুলে খেতে যাবেন এমন সময় তার মনে পড়ে যায় ইমাম হোসেন (রাঃ) এর তৃষ্ণার্ত শিশু সন্তানের কথা।পানি ফেলে দিয়ে মশক ভর্তি করে তাবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই শত্রু পক্ষের তীরে তার এক হাত কেটে যায়। মশকটাকে তিনি অপর হাতে নিয়ে ইমামের তাবুর দিকে ছুটলেন। এবার অপর হাতটিও কাটা পড়ে। মশকটাকে এবার তিনি মুখে নিয়ে তাবুর দিকে যেতে চাইলেন। শত্রুর তীর এবার সরাসরি তার দেহে আঘাত হানে। এ ভাবে শহীদ হয়ে যান তিনি। এর পর অসম এই যুদ্ধে আলী আকবর শহীদ হয়ে যান। কারবালায় আরো যারা শহিদ হন তাদের মধ্যে রাসূলের প্রিয় সাহাবা হাবিব ইবনে মাজাহের, তার প্রাচীন বন্ধু মুসলিম ইবনে আওসাজা, নওমুসলিম ওহাব সহ আরো অনেকেই।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দুরাবস্থায় পতিত হয়ে হুসাইন ওবায়দুল্লাহর নিকট তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটা গ্রহনের অনুরোধ জানান। তাহলো হয় তাকে মদীনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক, কিম্বা তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক, বা ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্যে দামেস্কে যেতে দেয়া হোক। কিন্তু ক্ষমতাদর্পী ওবায়দুল্লাহ এর কোনটাই মানলো না। এ দিকে পানির অভাবে হুসাইন শিবিরে হাহাকার পড়ে গেলো। ছোট শিশুরা মুর্ছা যেতে লাগলো। নিরুপায় হুসাইন শেষ বারের মত অনুরোধ করলেও, পাষান্ডদের মন গলেনি।
৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর কারবালার প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধ শুরু হলো। হুসাইনের ভ্রাতুষ্পুত্র কাশিম সর্ব প্রথম শত্রুর আঘাতে শাহাদাত বরন করলেন। তৃষ্ণার্ত হুসাইন শিশু পুত্র আসগরকে কোলে নিয়ে ফোরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলেন কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর শিশু পুত্রের শরীরে বিদ্ধ হয়ে শিশু পুত্রটি শাহাদাত বরন করলে একাকী অবসন্ন হুসাইন তাবুর সামনে বসে পড়লেন। এমন সময় এক মহিলা তাকে এক পেয়ালা পানি এনে দিলো। কিন্তু শত্রুর তীর তার মুখ বিদীর্ণ করে দিলো। সীমার নামীয় ইয়াজিদের এক সৈন্য তরবারীর আঘাতে হুসাইনের মস্তক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো। এই ভয়ন্কর দৃশ্যে কঠিন হৃদয়ও বিগলিত হলো।
হুসাইন পরিবারের জীবিত সদস্যদের বন্দী করে দামেস্কে ইয়াজিদের নিকট পাঠানো হয়। এ দিকে হুসাইনের মৃত্যুর এমন ভয়াবহ দৃশ্য পুরো দেশের মানুষকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলল। ইয়াজিদ ভয় পেয়ে গেলো। ক্ষমতা নিরাপদ রাখতে এবং জনরোষের ভয়ে কৌশলী ভুমিকায় সে বন্দিদের মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দিলো।
