প্রশ্নঃ মোনাফেক্বের আত্মপ্রকাশ হয় কখন এবং এদের চেনার উপায় কি?
উত্তরঃ প্রিয়বন্ধু! আস্-সালামু আলাইকুম। মোনাফেক্ব ভয়ংকর একটা নাম। যে ব্যক্তি মুখে সাধুতা প্রকাশ করে আর অন্তরে অসাধুতা পোষণ করে তাকে মোনাফেক্ব বলে। এরা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত। পরকালে এদেরকে কাফির ও মুশরিকের থেকে বেশি শাস্তি দেওয়া হবে। এবারে আমরা প্রশ্নের বিষয়টি জেনে নিই।
মোনাফেক্বের আত্মপ্রকাশঃ
মোনাফেক্বের আত্ম প্রকাশ সূচনালগ্ন থেকেই হয়েছে। হযরত আদাম (আ)-এর সাথে প্রথম মোনাফেক্বী করেছে ইবলিস। চরম হিতাকাংখী হয়েই সে তাকে জান্নাতের ফল ভক্ষন করিয়ে ছিল। হযরত নূহ (আ)-এর স্ত্রী ও হযরত লূত (আ)-এর স্ত্রী স্ব স্ব স্বামীর সাথে থেকে মোনাফেক্বীতে মত্ত থাকায় আল্লাহর গজব তাদেরকে রক্ষা করেনি। বিশ্বনাবী (ছা)-এর সাথে মোনাফেক্বী করেছে মুমিনের ছুরাতে মদীনাহর নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই। কূফাহ নগরীর মুনাফেক্বীতে ইমাম হুসাইনের শাহাদাত সংঘঠিত হয়। আর মীর জাফরের মোনাফেক্বীতে আমাদের উপর দুই শত বছরের গোলামী চেপে বসে।
মহান আল্লাহ নাবী (ছা)-কে মোনাফিক্বের জানাঝাহ, ক্ববর জিয়ারাত ও দুআ করতে নিশেধ করে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। তবে তাদের আত্ম প্রকাশের ক্ষেত্রে এতটুকু বলা যায় যে, মোনাফেক্ব বস্তুর ছায়ার মত। সূর্যের আলোর সম্মুখীন হবেন তো ছায়ার আত্মপ্রকাশ হবে। নতুবা হবে না। ঠিক তদ্রুপ মুমিন যখনই পূর্ণ গতিতে আত্মপ্রকাশ করে তখন মোনাফেক্ব ছায়ার মত বেরিয়ে আসে। আবার যখন মুমিন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন মোনাফেক্বীরও বিলুপ্তি ঘটে। অর্থাৎ সে তখন কাফির-মুশরিকদের মাঝে একাকার হয়ে যায়।
মোনাফেক্ব চেনার উপায়ঃ
এদেরকে চেনার ভাল কোন নাম-নিশানা নেই। কেননা পৃথিবীতে কেউ নিজেকে মোনাফেক্ব বলে স্বীকার করে না। তবে কাজে কর্মে এদেরকে চিনে রেখে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। মোনাফেক্ব চেনার উপায় হিসেবে কয়েকটি আয়াতে কুরআনীর প্রতি লক্ষ্য করুন।
(১) যখন তারা মুমিনদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি, আর যখন নিরিবিলিতে নিজেদের শায়ত্বানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে আমরা তো আসলে তোমাদের সাথেই রয়েছি। ওদের সাথে তো নিছক তামাশা করছি। (বাক্বারাহ্-১৪)
(২) যারা মাসযিদ নির্মাণ করেছে সত্যের দাওয়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে, আল্লাহর বন্দেগী করার পরিবর্তে কুফরী করার জন্য, মুমিনদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এবং এমন এক ব্যক্তির জন্য গোপন ঘাঁটি বানাবার উদ্দেশ্যে, যে ইতোপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। তারা অবশ্যই ক্বাসম খেয়ে বলবে, ভালো ছাড়া আর কোন ইচ্ছাই আমাদের ছিল না। (তাওবাহ্-১০৭)
(৩) তোমরা আর এক ধরনের মোনাফেক্ব পাবে, যারা তোমাদের থেকে নিরাপদ থাকতে চায় এবং নিজেদের সম্প্রদায় থেকেও। কিন্তু যখনই ফিতনাহ্-র (অর্থাৎ “প্রলোভন, দাংগা-বিশৃংখলা, গৃহযুদ্ধ, শিরক, কুফর, ধর্মীয় নির্যাতন ইত্যাদী”) সুযোগ পাবে তখনই তাতে ঝাপিয়ে পড়বে। (নিসা-৯১)
(৪) নিশ্চয়ই মোনাফেক্বেরা তো আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করে। অথচ আল্লাহই তাদেরকে ধোঁকার মধ্যে ফেলে রেখেছেন। তারা যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়। ইবাদাতে শামিল হয় কেবল লোক দেখানোর জন্যই এবং তারা আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে। (নিসা-১৪২)
(৫) মোনাফেক্ব নর এবং মুনাফিক্ব নারী একে অপরের অনুরূপ। তারা অসৎ কর্মে আদেশ দেয় এবং সৎ কর্মে নিষেধ করে এবং হাত বন্ধ করে রাখে। অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় কোন ধরনের ব্যয় করে না। তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে ফলে আল্লাহও তাদেরকে ভুলে গেছেন। নিশ্চয়ই মোনাফেকেরা পাপাচারী। (তাওবাহ্-৬৭)
(৬) তোমাদের ভাল হলে তাদের খারাপ লাগে এবং তোমাদের উপর কোন বিপদ এলে তারা তাতে খুশি হয়। তোমরা যদি ধৈর্যশীল এবং মুত্তাক্বী হও তাহলে তাদের কোন ষড়যন্ত্রই তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা করে আল্লাহ তাআলা নিশ্চয়ই তা পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। (আলি-ইমরান-১২০)
(৭) তারাতো তাদের শপথগুলোকে ঢালরূপে ব্যবহার করছে। আর লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করছে। নিশ্চয়ই তারা যা করছে তা কতই মন্দ। (মুনাফিকূন-২)
(৮) মানুষের মধ্যে এমন কতক লোক আছে, যে আল্লাহর ইবাদাত করে দ্বিধার সাথে অর্থাৎ ঈমান ও কুফরীর মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে। এর দ্বারা যদি মঙ্গল হয় কেবল তখনই তার চিত্ত প্রশান্ত হয় এবং কোন বিপর্যয় ঘটলে তখন সে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে তো দুন্ইয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্থ হলো। আর এটাই তো প্রকৃত ক্ষতি। (হজ্ব-১১)
(৯) মানুষের মধ্যে এমনও কতক লোক আছে, যারা বলে আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি। অতঃপর যখন তারা আল্লাহর পথে নিগৃহীত হয় তখন তারা মানুষের নিপীড়নকে আল্লাহর শাস্তির মত মনে করে। আর যদি তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে কোন সাহায্য আসে তখন বলতে থাকে, আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম। বিশ্ববাসীর অন্তঃকরণে যা আছে, আল্লাহ কি তা সম্যক অবগত নন।?(আনকাবুত-১০)
(১০) যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস কর যে, তোমরা কি কথা বলছিলে? তখন তারা ঝটপট করে বলবে, আমরা তো হাসি-তামাশা ও পরিহাস করছিলাম। তাদেরকে বল, তোমাদের হাসি-তামাশা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলের সাথে ছিল? এখন আর ওজর পেশ কর না। তোমরা তো ঈমান গ্রহণের পর কুফরী করেছো। যদি আমরা তোমাদের একটি দলকে মাপও করে দেই তাহলে আর একটি দলকে তো আমরা অবশ্যই শাস্তি দিব কারণ তারা অপরাধী। (তাওবাহ্-৬৫-৬৬)
(১১) তাদেরকে যখন বলা হয় পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি কর না। তখন তারা বলে, না, আমরা তো শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! এরাই প্রকৃত অশান্তি সৃষ্টিকারী কিন্তু তারা তা বুঝে না। (বাক্বারাহ্-১১-১২)
(১২) মোনাফেক্বেরা কুফর ও ঈমানের মাঝে দোটানায় দোদুল্যমান থাকে। না পুরাপুরি এদিকে, না পুরাপুরি ওদিকে। (নিসা-১৪৩)
(১৩) তোমরা তো তাদেরকে ভালোবাস কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালোবাসে না। অথচ তোমরা কিতাবকে মানো, তারা তোমাদের সাথে মিলিত হলে বলে আমরাও তোমাদের রাসূল ও কিতাবকে মেনে নিয়েছি। কিন্তু তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের ক্রোধ-আক্রোশ এতো বেশি বেড়ে যায় যে, তারা নিজেদের আঙ্গুল কামড়াতে থাকে। (আলি-ইমরান-১১৯)
এভাবে আরো আয়াতে কারীমা আছে।
কাজেই এ আয়াত সমূহে মোনাফেক্ব চেনার উপায় বিবৃত হয়েছে। আমরা এর দ্বারা সতর্কতা অবলম্বন করলে মুক্ত থাকবো। ইনশাআল্লাহ। ধন্যবাদ।